সগীর মুহাম্মদ
আল্লাহ প্রদত্ত পয়গাম ও ইসলামি শরিয়ার আলোকে মানুষের সামাজিক জীবনের সৌজন্যমূলক আচরণ, শিষ্টাচার, সৎকর্মশীলতা ও উন্নত নৈতিকতাকে ইসলামি সংস্কৃতি বলা হয়। মানুষের জীবনের সব কর্মকাণ্ডই ইসলামি সংস্কৃতির আওতাভুক্ত, যা মানবতার আদর্শ মুহাম্মদ (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ইসলামি চিন্তা-ঐতিহ্য, ইসলামি সংস্কৃতিকে যেভাবে উপস্থাপন করে, সে ভিত্তিতে তার সংজ্ঞা দাঁড়ায় নিম্নরূপ:
১. কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পরিচালিত জীবনাচার। জীবনযাপন, ক্রিয়াকলাপ ও আচরণের ইসলাম নির্দেশিত প্রতিফলনই হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতি।
২. যে আচার, ক্রিয়া, রুচি ও চেতনা জীবনকে সুন্দর করে, সুষমামণ্ডিত করে, শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে, ইসলামের মূল্যবোধলগ্ন, সেসব আচারের প্রতিফলন হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতি। এর মূলে আছে আল কোরআন ও মহানবীর জীবনে তার বাস্তবায়িত রূপ। শান্তি, সুখ, স্বাধীনতা ও সর্বজনীন কল্যাণই এর মুখ্য উদ্দেশ্য।
৩. ইসলামি সংস্কৃতি প্রধানত উন্নততর ভাবধারার সেই মানকে নির্দেশ করে, যা মহানবী (সা.) প্রবর্তিত ইসলামি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর আওতায় আসে সেই সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞান, যার ঐতিহ্য ও অনুপ্রেরণা নিহিত সেই আদর্শে, সেই শিক্ষায়। মুসলিমদের অনুশীলিত জীবনপ্রক্রিয়া, ধর্মাচার, সামাজিক নিয়ম ও ঐতিহ্যের যা কিছু ইসলামের নির্দেশনা ও অনুমোদন পায়, সেগুলোর সুকৃত ও প্রতিফলিত রূপ হচ্ছে ইসলামি সংস্কৃতি।
ইসলামি সংস্কৃতির গুরুত্ব এবং কতিপয় বৈশিষ্ট্য
কোরআন ও সুন্নাহ প্রদত্ত নীতি ও আচরণের অনুসরণের নামই যখন ইসলামি সংস্কৃতি, তখন কোনো মুসলমানের পক্ষেই ইসলামি সংস্কৃতির প্রশ্নে সংশয়প্রবণ হওয়ার সুযোগ নেই। এর অনুসরণ, ধারণ, বিস্তার ও জীবনে এর পূর্ণতা বিধানের প্রশ্নে ইতস্ততাবোধের সুযোগ নেই। অতএব, যেখানেই মুসলিম জীবন আছে, সেখানেই ইসলামি সংস্কৃতি থাকবে। মুসলিম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ সংস্কৃতি প্রাসঙ্গিক, আবেদনপূর্ণ, যার গুরুত্ব অনেক প্রবল, গভীর, বিরাট।
বাহ্যিক ও আত্মিক পবিত্রতা
ইসলামি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বাহ্যিক ও আত্মিক পবিত্রতা। আল্লাহতায়ালা নিজে পবিত্র এবং তিনি পবিত্রতা পছন্দ করেন। পবিত্রতা বলতে বাহ্যিক বা দৈহিক এবং অন্তরের বা মনের উভয় প্রকার পবিত্রতা বোঝায়। ইসলাম উভয় ধরনের পবিত্রতার ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। ইবাদতের জন্য যেমন পবিত্রতা দরকার, তেমনি থাকাণ্ডখাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবিকা অর্জন, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে পবিত্রতা বা বিশুদ্ধতার ওপর ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। ইসলামি সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে যে বিশেষ ধরনের মন ও মননশীলতা সৃষ্টি করে, তা সব ধরনের কলুষতা, আবিলতা, পংকিলতা, সংকীর্ণতা, হঠকারিতা, কপটতা, ধোঁকা, প্রতারণা, বকধার্মিকতা, অশ্লীলতা, উলঙ্গতা, নির্লজ্জতা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, পাষ-তা, অমানবিকতা, জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, অসুন্দর, বেমানান, বেআদবি, পাপাচার ও নোংরামি থেকে সম্পূর্ণ পূতপবিত্র হবার জন্য তাড়িত করে। এর অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা দেয়। এর অনুকূল আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।
কুসংস্কারমুক্ত
সব ধরনের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কুসংস্কার একটি সামাজিক ব্যাধি, যা সমাজের অধঃপতন ঘটায়; সমাজের মধ্যে অশান্তি ও অমঙ্গল টেনে আনে; এর কারণে সামাজিক অবক্ষয় ঘটে। তাই এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। কুসংস্কার অর্থ ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস, সামাজিক প্রথা বা ধর্মের বিষয়ে দলিলহীন ও যুক্তিহীন বিশ্বাস, অশুদ্ধ, অমার্জিত বা দূষণীয় কাজ। এখানে কুসংস্কার বলতে সেসব কৃষ্টি, আচরণ, অভ্যাস, প্রথা, ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলোকে সিদ্ধ, সভ্যতা, পুণ্য ও ধর্মের অংশ মনে করা হয়, অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে তা সভ্যতা ও দ্বীনের আওতায় পড়ে না।
বস্তুত সেগুলো ইসলামি রীতিনীতি ও সভ্যতার পরিপন্থি বলেই বিবেচিত। হাদিসে এ জাতীয় বিষয়কেই মুহদাসাতুল উমুর (নব আবিষ্কৃত বিষয়াদি) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এগুলোর ওপর আমল করা গোমরাহি, যা ব্যক্তিকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। রাসুল (সা.) সমগ্র উম্মতকে সব ধরনের কুসংস্কার ও বিদাতকে পরিত্যাগ করে একমাত্র তাঁর ও সাহাবিদের সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এতেই রয়েছে চিরকল্যাণ ও শান্তি। মূলত সুষ্ঠু ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে কুসংস্কারের মূলোৎপাটন আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব হলো কুসংস্কার বা বিদাতকে কোনোরূপ প্রশ্রয় না দেয়া।
মানবতাবোধ
ইসলামি সংস্কৃতির আরেক অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবোধ। মোমিনের জীবনবোধ মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ। মানবতাবোধ মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ; বরং এটিই মানুষের শ্রেষ্ঠতম মানবিক গুণ। মানবতাবোধ হলো, মানুষের জন্য অনুভূতি, মানবিক চেতনা, মানুষের কল্যাণ কামনা, মানুষের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হওয়া এবং মানুষের সুখ-শান্তিতে আনন্দিত হওয়া। এ বোধ থেকেই মানুষ মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করে, মানুষ মানুষের উপকারে তৎপর হয়, মানব কল্যাণে ব্রতী হয়। মানুষের উন্নতি ও সর্বাঙ্গীণ সুখ-শান্তি বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করে। এ বোধ থেকেই মানুষ মানুষের প্রতি সুবিচার করে, মানুষ মানুষের অধিকার দিয়ে দেয়, অধিকার সংরক্ষণ করে। মানুষের অধিকার লুণ্ঠিত হলে, মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন হলে অপর মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এরই নির্দেশে দয়া ও অনুকম্পার অভ্যাসকে সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত করে ইসলামি সংস্কৃতি। ন্যায়, ইনসাফ, কল্যাণ, ত্যাগ ও অন্যের দুঃখমোচনের প্রয়াস ইসলামি সংস্কৃতির অবধারিত অংশ।
সাংস্কৃতিক এই বোধ ও বাস্তবতার অভাবেই মানুষ মানুষের অধিকার হরণ করে, মানুষ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়, মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয়, মানুষের দুঃখ-কষ্টে মানুষ ব্যথিত হয় না, মানব-কল্যাণে এগিয়ে আসে না, মানব সেবায় ব্রতী হয় না। এরকম মানুষ মানবীয় চেতনাবোধহীন। মূলত এটিই হলো জড়বাদী খোদাহীন সংস্কৃতির আত্মকেন্দ্রিকতার অভিশাপ।
সৌন্দর্যবোধ
ইসলাম দিয়েছে এক অনুপম আদর্শ সংস্কৃতি। তাওহিদি ঈমান এর উজ্জীবনী শক্তি। আত্মিক ও নৈতিক পবিত্রতা এর প্রাণ। ইসলামি সংস্কৃতির এই অন্তর্গত সৌন্দর্যই তার ব্যবহারিক ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রবর্তক। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লবের পর শিল্প-কারখানা এবং শিল্পকলা সব জায়গায় মানবিক মূল্যবোধ উপেক্ষিত হয়েছে। সব ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দর্শন তাদের জীবনব্যবস্থাকে গ্রাস করে দিয়েছে। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো অস্কার ওয়ার্ল্ডের ঘোষণা Art for art sake. কিন্তু ইসলামি জীবনদর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামি দর্শনে এক মহান উদ্দেশ্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সে প্রতি মুহূর্তে সচেতন ও সক্রিয়। তার জীবনের একটি মুহূর্তও লক্ষ্য বিবর্জিত থাকে না। ক্ষুদ্র থেকে বড় কোনো কাজই তার লক্ষচ্যুত নয়। জীবনের সব বিষয়ের মতো শিল্পকলার ক্ষেত্রেও সে লক্ষ্যহীন নয়। আদর্শচ্যুত নয়। মানবকল্যাণ, মানবতাবোধ এবং জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের তীব্র অনুভূতিতে সে সদা সক্রিয়। মোমিনের সব কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতিবিম্বিত। সর্বত্রই সে তার মহামনিবের ইচ্ছা কার্যকর করে। সর্ব সময় সে আল্লাহমুখী থাকে। রাসুলের আদর্শ থেকে সে কখনও বিচ্যুত হয় না। আখেরাতের মুক্তিচেতনা কখনও তার বিবেককে শিথিল করে না। ফলে Art for art sake নয়, ইসলামের কাছে আর্ট হলো মানব ও সামাজের কল্যাণের হাতিয়ার। কিন্তু একই সঙ্গে তা শিল্পরুচি ও আর্টের ঋদ্ধিতে নিরাপোশ। ফলে শিল্প ও সমাজ ইসলামি সংস্কৃতিতে সমান্তরাল। এখানে আর্টের মূলনীতির উৎস হয় রাসুলের আদর্শ। মোমিনের সব আর্ট বা শিল্প যেভাবে শৈল্পিক সুন্দরতায় হবে অনিন্দ্য, তেমনি হবে আদর্শভিত্তিক এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকেন্দ্রিক।
উদারতা, জ্ঞানালোক ও গতিশীল জীবনচেতনা
ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি এক স্বচ্ছ, উদার ও গতিশীল জীবনচেতনার প্রাণবন্ত বহিঃপ্রকাশ। ইসলামি সংস্কৃতি এমন একটি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত, যার মূল ভিত্তি হলো আল্লাহভীতিপূর্ণ সদাচার। ইসলামে বর্ণ, পেশা, পদ, রক্ত, গোত্র, সম্পদ ইত্যাদির দ্বারা সামাজিক বা মানবিক মর্যাদা নির্ধারিত হয় না, তাকওয়া বা আল্লাহভীতিই সেখানে মর্যাদার মাপকাঠি। কোরআন ও হাদিসের বহু স্থানে এই কথার প্রতিধ্বনি হয়েছে বারবার। বিদায় হজের ঐতিহাসিক বাণীতে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে মানুষ সকল, জেনে রেখ! নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। অতএব, কোনো অনারবের ওপর আরবের এবং কোনো আরবের ওপর অনারবের প্রাধান্য নেই। অনুরূপভাবে কালো বর্ণের ওপরে সাদা বর্ণের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং সাদা বর্ণের ওপর কালো বর্ণের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হয় শুধু তাকওয়ার মাধ্যমে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২৩৯৯)।
কোনো অঞ্চলিক, জাতীয়, বংশীয় বা গোত্রীয় সংস্কৃতি নয়; ইসলামি সংস্কৃতি; বরং তা হচ্ছে বৃহত্তর মানবীয় সংস্কৃতি। তাওহিদের বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত এক মোমিন রিসালাতের বিশ্বাস ও অনুবর্তিতায় আখেরাতের বোধে হন বলিষ্ঠ। তিনি যে কালে, যে দেশে, যে সমাজে থাকুন, ইসলামি সংস্কৃতি তাকে আপন মাতৃক্রোড়ে দুগ্ধদান করবে। তিনি যে বর্ণের হোন, যে গোত্রের হোন, যে ভূখণ্ডের হোন। ইসলামি সংস্কৃতির সর্বজনীনতা গোটা বিশ্বের প্রতিটি মানবগোষ্ঠীকে নিজের পরিসরে জায়গা দেয়, জায়গা দিতে প্রস্তুত।
এ সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো জ্ঞানশীলতা। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান ও গবেষণাকে এ সংস্কৃতি কত গভীরভাবে, কত ব্যাপকভাবে এবং কত তীব্রভাবে প্রণোদিত করে, তার সাক্ষ্য কোরআন-সুন্নাহ থেকে নিয়ে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে ব্যাপক ও বিস্তর। এ সংস্কৃতিতে নৈতিকতাণ্ডআধ্যাত্মিকতা যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জ্ঞানীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এখানে অবিষ্ট। ইসলামি সমাজ মানেই জ্ঞানালোকিত, নৈতিক ও প্রাগ্রসর এক সমাজ। কালের প্রবাহে এ সংস্কৃতিতে অচলাবস্থা আসার সুযোগ নেই। কারণ তাতে আছে কোরআন-সুন্নাহর স্থিতিস্থাপকতা, সঙ্গে আছে জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিশীল চলমানতা। জীবনের পরিসর যতটা, জীবন যেখান থেকে যেখানে যায়, সবখানেই এ সংস্কৃতির অভিগমন রয়েছে। প্রতিটি পরিবর্তিত বাস্তবতাকে নিজের গলনপাত্রে সিদ্ধ করতে পারে এ সংস্কৃতি, নিজস্ব মূলনীতির অনুকূলে। ফলে গতিশীল জীবনের কোনো মাত্রা থেকে সে পিছিয়ে থাকে না। সে নিত্যই চলমান, যেমন চলমান মানবজীবন