বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জহির রায়হান ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসেই শুনলেন তার অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। আদর্শস্থানীয় বড় ভাইকে হারিয়ে তিনি পাগলের মত তাকে খুঁজতে থাকেন। তার উদ্যোগে বেসরকারি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ঘটনার প্রচুর প্রমাণাদি তিনি সংগ্রহ করেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, তার সংগৃহীত প্রমাণাদি প্রকাশ করলেই অনেকের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন হোটেলে বিলাসবহুল ও আমোদ-ফুর্তিময় জীবনযাপন, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসহীন বাঙালিদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্র প্রভৃতির প্রামাণ্য দলিল জহির রায়হান কলকাতা থাকাকালে সংগ্রহ করেছিলেন। বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের নিখোঁজ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি তাকে বিচলিত করে। এসব ঘটনা তাঁর পূর্বেকার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেয়।
এখানে উল্লেখ্য যে ২২শে ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনীর হাতে শহিদুল্লাহ কায়সারের অপহরণকারী হিসেবে চিহ্নিত এক রাজাকার গ্রেফতার হয়েছিল যাকে শহিদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার উপস্থিত হয়ে নিজে শনাক্তও করেছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তি সপ্তাহ খানেক পর কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে। পরবর্তীতে দালাল আইনে গ্রেফতার হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমায় অন্য সকলের মতো সেও মুক্তি লাভ করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ১৫ দিন পর ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কৃতি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ঘোষণা দেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে নীলনকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তার কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেয়া আ.লীগের অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে পড়বে। আগামী ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এই প্রেসক্লাবে ফিল্ম শো প্রমাণ করে দেবে কার কি চরিত্র ছিল।
১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েকদিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে এক রফিক নামের অজ্ঞাত টেলিফোন আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। রফিক ছিলেন জহিরের পূর্ব পরিচিত যিনি ইউসিসে চাকরি করতেন । প্রথমে ফোন ধরেছিলেন জহির রায়হানের ছোট বোন ডাক্তার সুরাইয়া যার কাছে জহিরকে খোঁজা হচ্ছিল। সুরাইয়া জহির রায়হানকে ডেকে ফোন ধরিয়ে দেয় । টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা মিরপুর বারো নম্বরে বন্দি আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে এক্ষুণি মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দু’টো গাড়ি নিয়ে মিরপুরে রওনা দেন। তার সাথে ছিলেন ছোট ভাই মরহুম জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল (সুচন্দার ভাই), আব্দুল হক (পান্না কায়সারের ভাই), নিজাম ও পারভেজ। মিরপুর ২নং সেকশনে পৌঁছার পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং স্বৈরাচার মুজিবের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়ি (ঢাকা-ক-৯৭৭১)সহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। শাহরিয়ার কবির অন্যদের সাথে করে বাড়ি ফিরে আসেন । এভাবেই জহির চিরতরে হারিয়ে যায়। অথচ সেদিন বিকেলেই প্রেসক্লাবে তার কাছে থাকা অনেক দুর্লভ তথ্য প্রমাণ ফাঁস করার কথাছিল যা ফাঁস হলে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে খাওয়া আ.লীগের অনেকের মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যেতো যা আর কোনদিন করা হলো না ।
জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার মাস দেড়েক পর শহিদুল্লা কায়সার ও জহির রায়হানের বোন নাফিসা কবির, শহিদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, জহিরের ২য় স্ত্রী সুচন্দাসহ ১৯৭১ সালে নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের অনেকে স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে গেলে স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে বাড়ির গেইটে অপেক্ষামান রাখেন। এক সময় শেখ মুজিবুর রহমান গেইটের সামনে এসে বিক্ষোভ ও দেখা করার কারণ জানতে চাইলে এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে নাফিসা কবিরের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
[সূত্র – মুক্তিযুদ্ধ : আগে ও পরে / পান্না কায়সার [আগামী প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১ । পৃ: ১৬৮]