সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর ব্যুরো
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি যন্ত্র অচল হয়ে আছে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে। চালুর উদ্যোগ নেয়নি কেউ। ফলে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সোর চিকিৎসা কার্যত ব্যাহত হচ্ছে। যদিও শুধু ২০২৩ সালে হাসপাতালটিতে ক্যান্সার রোগী ভর্তি হয়েছিল দুই হাজার ৮৪৬ জন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের আট জেলায় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের জন্য একমাত্র ভরসাস্থল ছিল রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল। গত ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে রেডিওথেরাপি যন্ত্রটি অচল হয়ে থাকায় কার্যত ক্যান্সার চিকিৎসা হচ্ছে না এ অঞ্চলে।
হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের (ক্যান্সার বিভাগ) প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক জাহান আফরোজ খানম জানান, ২০০১ সালের ১২ জুন রেডিওথেরাপি মেশিনটি বসানো হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত রোগীদেরকে রেডিওথেরাপি দেয়া সম্ভব ছিল। তখন প্রতিদিন গড়ে ১০০ রোগীকে রেডিওথেরাপি দেয়া হতো। কিন্তু ২০১৫ সালে রেডিওথেরাপি মেশিনটি অচল হয়ে পড়লে তারা স্থাস্থ্য অধিদফতরকে কয়েকবার তাগাদা দেন। কিন্তু মেশিনটি মেরামতের আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত ১ ও ২ জানুয়ারি সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরজমিন দেখা যায়, পাঁচটি শয্যায় ক্যান্সার আক্রান্ত নারী-পুরুষ গাদাগাদি করে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। এক শয্যায় চার-পাঁচজন বসা। ক্যান্সার বিভাগের প্রধান বললেন, কেমোথেরাপি দিতে রুমে সঙ্কটের কারণে এ অবস্থা। এই হাসপাতালের ক্যান্সার চিকিৎসক ডা: মনি রানী জানান, প্রতিদিন গড়ে ৯০ জন ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের ৪০ জনকেই কেমোথেরাপি লাগে। অন্তর্বিভাগে রোগী ভর্তি থাকে ১০-১৫ জন। এ হিসেবে বছরে অন্তত ৪০ হাজার ক্যান্সার রোগী চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশের রেডিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
তিনি আরো জানান, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সাধারণত তিনটি পর্যায়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়- সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। এর মধ্যে রোগের ধরনের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা রেডিওথেরাপির পরামর্শ দেন। সরকারি পর্যায়ে রেডিওথেরাপির জন্য গড় ব্যয় হয় ছয় হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। অন্য দিকে একই রেডিওথেরাপি বেসরকারি পর্যায়ে ব্যয় হয় এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা। এত উচ্চ ব্যয় বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। জানা গেছে, রংপুর বিভাগের আট জেলার রোগীদের জন্য নিকটবর্তী হিসেবে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে একটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র ছিল। কিন্তু দেড় বছর ধরে সেটিও বিকল হয়ে আছে।
ক্যান্সার রোগী ও তাদের স্বজনেরা বলছেন, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এখন ভরসাস্থল ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে চার থেকে ছয় মাসের আগে সিরিয়াল পাওয়া যায় না। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন সচল থাকলেও ভিড়ের কারণে বাইরের রোগীরা সুযোগ পান না। রংপুর সিটি করপোরেশনের ছোটাপীড় এলাকার বাসিন্দা রোজিনা বেগম (৩৫) জানান, গত বছর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হই। এরপর রংপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে অপারেশন করি। কেমোথেরাপি দিই রংপুর মেডিক্যাল হাসপাতালে। কিন্তু রেডিওথেরাপি দিতে পারিনি। ঢাকা কিংবা বগুড়ায় গিয়ে থেরাপি দেয়ার সামর্থ্যও নেই। তিনি জানান, শরীরের ওই অংশে টিউমার দেখা দিয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর আবারো নতুন করে অপারেশন করাতে হয়েছে।
নীলফামারীর ডিমলার বাসিন্দা আলম হোসেন (৫৫) জানান, সাত মাস আগে আমার মুখে ক্যান্সার ধরা পড়ে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (রমেক) আমার অপারেশন হয়। চিকিৎসক আমাকে রেডিওথেরাপি দিতে বলেন। কিন্তু রেডিওথেরাপি যন্ত্রটি অচল থাকায় আমি এখনো থেরাপি দিতে পারিনি। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগ জানায়, রংপুর বিভাগে সোর আক্রান্ত দুই হাজার ৮৪৬ রোগীর মধ্যে শুধু রংপুর জেলাতেই ক্যান্সার রোগি রয়েছে এক হাজার ৩৮৯ জন। এ ছাড়া নীলফামারী জেলায় ৩১৬ জন, গাইবান্ধায় ২৮৪ জন, কুড়িগ্রামে ২৭৭ জন, লালমনিরহাটে ২০৯ জন, পঞ্চগড়ে ১৩১ জন, দিনাজপুরে ১২৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬২ জন এবং অন্যান্য এলাকায় আরো ৫০ জন ক্যান্সার রোগী রয়েছে। ক্যান্সার গবেষক ডা: রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল বলেন, এই বিভাগের ক্যান্সার রোগীদের জীবন বাঁচাতে কমপক্ষে দু’টি রেডিওথেরাপি থাকা জরুরি। সেখানে একটিও নেই। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, নতুন রেডিওথেরাপি যন্ত্রের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে তিনি শিগগিরই কথা বলবেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে কেমোথেরাপি রুমের সঙ্কট দূর হবে।